আলো-ছায়ার মাস্টার নাসির আলী মামুন

নাসির আলী মামুন স্বাধীন বাংলাদেশের পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির পুরোধা। তার লেন্সেই রচিত হয়েছে পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির কাব্যময়তা। নিরন্তর পোর্ট্রেট তোলার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা নাসির আলী মামুন ছুটে বেরিয়েছেন দেশ-দেশান্তরে। তার তোলা পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি। শিল্পী, লেখক, রাজনীতিবিদ, বিশ্বের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা হয়ে উঠেছেন তার শিল্পিত লেন্সের অন্তর্র্দর্পণ। এছাড়া তার একটি বিশেষ শখ শিল্পীদের শিল্পকর্ম সংগ্রহ এবং খ্যাতনামা ব্যক্তিদের হাতে খাতা ও রঙ-তুলি দিয়ে ছবি আঁকিয়ে নেয়া। ব্যক্তিত্বের পোর্ট্রেট সংগ্রহের পাশাপাশি ব্যক্তিত্বের গহিনে লুকিয়ে থাকা অন্য এক সত্তাকে তিনি আবিষ্কার করে আনেন। ব্যক্তির মননে লুকিয়ে থাকা শিল্পীরতœ জাদুকরী নান্দনিক রেখায় ধরা দিয়েছে নাসির আলী মামুনের সমৃদ্ধ শিল্প সংগ্রহশালায়। বাংলাদেশের শিল্পী শাহাবুদ্দীন, রনী আহম্মেদ, কাজী আবুল কাশেম, আমিনুল ইসলাম, কামরুল হাসান, যোগেন চৌধুরী, সুহাস চক্রবর্তী, দেবদাস চক্রবর্তী, মনিরুল ইসলাম, ড. মো. ইউনূস, পরিতোষ সেন, সন্তুর সম্রাট শিবকুমার শর্মা, ঠুমরি রানী বিদুষী গিরিজা দেবী, কবি শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবদুর রাজ্জাক, শিল্পী এসএম সুলতানÑ কে নেই তার সংগ্রহশালায়? উল্লেখ্য, নাসির আলীর মামুনের একটি ব্যক্তিগত আর্কাইভ বা মিউজিয়াম গড়ার জন্যে তিনি ‘ফটোজিয়াম’ শীর্ষক মিউজিয়াম নির্মাণে কাজ করছেন কয়েক বছর ধরে। ক্যামেরায় ছবি তোলার পাশাপাশি তিনি পরম যতেœ সংগ্রহ করেছেন শিল্পী-সাহিত্যিক এবং সৃজনশীল ব্যক্তিত্বদের আঁকা বিভিন্ন মাধ্যমের দুর্লভ সব ছবি। তার দুর্লভ সংগ্রহ নিয়ে বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টস এর আগেও ‘তার আলো তার ছায়া’ শীর্ষক প্রদর্শনীর আয়োজন করে, যা ছিল এক ব্যতিক্রম সংগ্রাহকের অনন্যতম প্রদর্শনী। আর এবার খ্যাতনামা ৫০ জন শিল্পীর আঁকা ‘রবীন্দ্রনাথ’ নিয়ে আয়োজিত হতে যাচ্ছে বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে এক অনবদ্য প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীকে উপলক্ষ করে খ্যাতনামা পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফার নাসির আলী মামুনের সাভারের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিল আমাদের প্রতিবেদক। সেখানেই চারবেলা চারদিক-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন হলেন নাসির আলী মামুন।

প্রশ্ন : খ্যাতনামা পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফার হিসেবে আপনি পরিচিত। আপনিই পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি প্রথম বাংলাদেশে শুরু করেছিলেন। আপনি শিল্প সংগ্রাহক কীভাবে হলেন তা জানতে চাই।
নাসির আলী মামুন : আসলে আমার ভেতর রয়েছে এক আর্কাইভাল জিন। আমার পিতৃকুলের পূর্বপুরুষরা সম্রাট বাহাদুরশাহ জাফরের (মোগল সম্রাট) অধীনে ইতিহাস সংগ্রহের কাজ করতেন। তারা ছবি আঁকতেন, কবিতা লিখতেন। সে পরম্পরায় কয়েক পুরুষ ধরে তারা ইতিহাস লিখেছেন, সংগ্রহ করেছেন। খুব ছোটবেলা থেকেই আমার ভেতরে মুদ্রা সংগ্রহ, ছবি তোলা, স্মৃতি সংগ্রহ করার এক নিরন্তর চেষ্টা ছিল। পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির নেশা আমাকে পার্থিব চিন্তা-ভাবনার ঊর্ধ্বে নিয়ে যেত। আমার দাদা-বাবা বলতেন, পূর্বপুরুষের জিনের প্রভাবেই হয়তো। কিন্তু নেশাটিকে ধরে রাখার নিরন্তর এই লড়াইয়ে মুখোমুখি হতে হয়েছে জীবনযুদ্ধ চালানোর দুঃসহ বাস্তবতার। ১৯৭৬ সালে খ্যাতনামা কার্টুনিস্ট ও চিত্রশিল্পী আবুল কাশেমের ছবি তুলতে যাই। অটোগ্রাফ নিতে চাইলে তিনি আমার পোর্ট্রেট এঁকে দেন। সেই শুরু। ৫০টির মতো ড্রইং করে দেন তিনি। অনেকের ছবি তুলতে যেতাম, আজ বলতে পারি ২০ টাকার খাতা কিনে নিয়ে যেতাম। এমনও হতো, সে সময় ভালো ডায়রি কেনার পয়সা থাকত না।

প্রশ্ন : আপনি অনেক অনেক গুণী ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছেন। তারা তো নিশ্চয়ই নানাভাবে আপনাকে প্রভাবিত করেছেন ছবি তোলার ক্ষেত্রেÑ এ বিষয়ে একটু বলবেন কি?
নাসির আলী মামুন : এটি খুব সত্যি, নানা গুণীজনের সংস্পর্শে এসে আমি তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সবচেয়ে মূল্যবান যে জিনিসটি শিখেছি সেটি হলো, দেশকে ভালোবাসা ও দেশের জন্যে কিছু করা। শিল্পী সুলতানের কাছে শিখেছি অন্য রকম ছবি। তার ছবির মধ্যে একটি বার্ডস আই ভিউ রয়েছে। সুলতান নিজেই একে বলতেন, বার্ডস আই ভিউ। তারপর ধরুন ম্যাসকুলিন ফিগার। ওনার আঁকা ফিগার ছিল অন্য শিল্পীদের চেয়ে আলাদা। আমাকে বলতেন, পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি অনেকেই করে, কিন্তু অন্যের সঙ্গে মিলে গেলে আপনি হারিয়ে গেলেন। কত নদীর পানি সাগরে মেশে, দেখবেন পদ্মা-মেঘনা নদীর পানি কিন্তু আলাদা। কবি শামসুর রাহমান বলতেন, মুড়ি-মুড়কির মতো কবিতা লিখলেই হবে না। আমার নিজস্ব সুর, ছন্দ, চিত্রকল্প থাকতে হবে। ফটোগ্রাফি তো আসলে সুরের মতো, কবিতার মতো। সব শিল্পের নির্যাস যেমন কবিতায়, তেমন আমি মনে করি ভিজ্যুয়াল শিল্পসমগ্রের নির্যাস হলো ফটোগ্রাফি। তার মধ্যে আর্কিটেকচার, পেইন্টিং, ভিডিও, সংগীতও রয়েছে। বর্তমান পৃথিবীর সব শিল্পের কেন্দ্র ফটোগ্রাফিতে। তার মধ্যে সবচেয়ে পরমাত্মা যেন স্টিল ফটোগ্রাফিতে। খসখসা, নির্জীব, স্থির, ব্রোমাইড পেপারের মধ্যে যে প্রাণ বোঝাতে পারে সে-ই বড় শিল্পী, সবচেয়ে বড় কৌশলী।

প্রশ্ন : আপনি একজন দুর্লভ আর্ট কালেক্টর। কারণ আপনার সংগ্রহে স্বদেশি-বিদেশি শিল্পীদের যে শিল্পকর্ম রয়েছে তা শুধু আপনার জন্যেই তারা এঁকেছেন এবং মজার বিষয়, বহু শিল্পীর পেনসিল ও তুলিতে তারা আপনার পোর্ট্রেটও এঁকেছেনÑ সেটা কীভাবে হলো?
নাসির আলী মামুন : শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছবি তুলেছিলাম। এরপর তিনি আমাকে এঁকে দেন ধু-ধু প্রান্তর। শিল্পী ধীরাজ চৌধুরী, পরেশ মাইতি, বিপিন গোস্বামী, ওয়াসিম কাপুর, মুর্তজা বশীর, সুনীল দাস, রবিন ম-ল, যোগেন চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, গণেশ হালুই, শেখ আফজাল, হামিদুজ্জামান খান, মুনিরুল ইসলামÑ আসলে আমার সৌভাগ্যের তালিকাটা খুবই বড়। এরা সবাই আমাকে বিভিন্ন সময়ে তাদের আঁকা ছবি দিয়েছেন। আমার পোর্ট্রেটও উঠে এসেছে তাদের তুলিতে। প্রখ্যাত শিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রীর সঙ্গে আমার দেখা হয় আমেরিকায়। দীর্ঘ সময় দীর্ঘদিন তার সংস্পর্শ পাই। এত ভার্সেটাইল গুণের অধিকারী মানুষ খুব কম দেখেছি। মনে আছে, তিনি আমাকে অজস্র ঘোড়ার ড্রইং দেখিয়েছিলেন। তিনি ২শ’র ওপরে ঘোড়ার ড্রইং জানতেন। সত্যি বলতে কি, আমি এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলাম যে, আজো আমি স্বপ্নে পূর্ণেন্দু পত্রীর ঘোড়া, ঘোড়ার ছুটে চলা দেখতে পাই। যেমন শিল্পী এসএম সুলতানের জীবনও ছিল এক অদ্ভুত দর্শনের। তিনি ছিলেন ভিন্ন মাত্রার দার্শনিক। তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ সময় কেটেছে। এমনসব জায়গায় তিনি নিয়ে যেতেন, যেখানে সাধারণ মানুষরা যেত না। অজস্র সাপ, পোকামাকড়, গভীর জঙ্গল, পোড়োবাড়ি, অন্ধকার শ্মশানের সামনে দিয়ে গভীর রাতে চলাফেরা করতেন তিনি নির্বিঘেœ। ওনার র‌্যাকের মধ্যে থাকত বেজি, বনমোরগ, সাপ- এমনসব অদ্ভুত জন্তু। তাদের নানাজনের নানা আওয়াজ। শিল্পী সুলতান নিজেই নিজের খাবার ভালোভাবে জোটাতে পারতেন না, তার ওপর এতসব পোষ্য। মনে পড়ে, তিনি ঘরে ঢুকলে ওরা শান্ত হয়ে যেত। তিনি প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলতেন এবং আশ্চর্য ওরা ওনার কথা বুঝত! যেমন একবার বললেন, ‘তোমরা শান্ত হও। ঢাকা থেকে ফটোগ্রাফার মেহমান এসেছে, ঘুম দরকার। কাল সকালে আমরা গ্রামে যাব। এ রকম চ্যাঁচালে উনি ঘুমাবেন কী করে? আজ তোমাদের খাবার জোগাড় করতে পারিনি। কাল এনে দেব।’ সত্যি ওরা চুপ হয়ে গেল। আবার তিনি বাইরে গেলে শুরু করত। ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। ওখানে কি নিশ্চিন্তে ঘুমানো সম্ভব? শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী দীর্ঘদিন বাক্যহীন বিমূঢ় জীবনযাপন করে গেছেন। স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে ডুবসাঁতার দিয়ে তিনি আমাকে এঁকে দিয়েছিলেন অনেক মুখাবয়ব। মনে পড়ে, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কথা। কর্কট রোগের দুঃসহতায় বিদীর্ণ তিনি। প্রিয় সন্তানের মুখ, কখনো প্রকৃতি, নিঠুর পাষাণের বুক ভেদ করে ফোটা রঙিন ফুলের ছবি। এমন দুর্লভ কিছু হৃদয়কুসুম এঁকে দিয়েছেন তিনি আমাকে। এমন অজস্র স্মৃতি-মালিকা জমে রয়েছে, যা বলে শেষ করা যাবে না।

প্রশ্ন : এমন দুর্লভ সংগ্রহ প্রদর্শনী করছেন, এতে সমৃদ্ধ হচ্ছে দর্শক ও শিল্পরসিকরা। কিন্তু বিক্রি হয়ে গেলে আপনার শূন্য লাগবে না?
নাসির আলী মামুন : সত্যি, এটি খুবই স্পর্শকাতর অনুভূতি। আমার এত দীর্ঘ সময়ের স্মৃতি ও শ্রমের দুর্লভ সংগ্রহরতœ। পৃথিবীর যে কোনো রতœ বা পুরস্কারের চেয়েও এগুলো মূল্যবান। কিন্তু এর পেছনে একটি বড় কারণ হলো, আমার ‘ফটোজিয়াম’ নির্মাণ। এটি আমার স্বপ্ন। এক্ষেত্রে আমার কোনো পৃষ্ঠপোষক নেই। আমাকেই সব করতে হবে। এই দুর্লভ সংগ্রহের বিক্রয়লব্ধ টাকা সম্পূর্ণ চলে যাবে আমার ‘ফটোজিয়াম’ নির্মাণে, যা হবে একটি পূর্ণাঙ্গ আলোকচিত্র জাদুঘর। এছাড়াও সেখানে থাকবে আমার তোলা বিভিন্ন শিল্পীর পোর্ট্রেট আর সঙ্গে তাদের শিল্পকর্ম।

পুনশ্চঃ একজন নাসির আলী মামুন হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে সাধনানির্ভর কঠোর শ্রম। শত বাধা, শত দুঃখ-যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে তিনি লক্ষ্যে এগিয়ে গেছেন, সচল রেখেছেন তার লেন্স। বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান তাকে ‘ক্যামেরার কবি’ বলে আখ্যা দিয়ে গেছেন। ১৯৫৩ সালের ১ জুলাই তার জন্ম। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর হলেও শৈশব-কৈশোর কেটেছে পুরান ঢাকায়। আজিমপুর কিন্ডারগার্টেন, ধানমন্ডি গভর্মেন্ট হাইস্কুলের পর ঢাকা কলেজে পড়াশোনা করেছেন তিনি। বেশ মজার ছিল তার বিয়ের স্মৃতি। প্রণয়ের পর বিয়ে। শ্বশুর জানতেন, জামাইয়ের নির্দিষ্ট কোনো রোজগার নেই। তাই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার পর শ্বশুরমশাই বরের হাতে কনেকে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আমার মেয়েটিকে খেতে দিও!’ ১৯৭২ সালে নাসির আলী মামুনই প্রথম বাংলাদেশে পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির সূচনা করেন। মাদার তেরেসাঁ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিল ক্লিনটনÑ এমন অগুনতি গুণীজনের পোর্ট্রেট তুলেছেন তিনি। বিশ্বখ্যাত জার্মানির লেখক গুন্টার গ্রাস, অ্যালেন্স গিন্সবার্গ, প-িত রবিশঙ্কর এমন অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব নাসির আলী মামুনকে আলো-ছায়ার মাস্টার বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার স্বপ্নের ‘ফটোজিয়াম’-এর জন্যে আন্তরিক শুভ কামনা।

 

Source: Charbela Chardik

Enter your keyword